ইসলামী আন্দোলনের গোলটেবিল বৈঠকে ঐক্যমত্য পতিত ফ্যাসিস্ট, গণহত্যাকারী, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে -পীর সাহেব চরমোনাই
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী ও দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারী শেখ হাসিনার সহ তার দোসরদের আগামী নির্বাচনে অযোগ্য এবং বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, ফ্যাসিবাদী খুনি সরকারের বিচার ও নির্বাচনে তাদের অযোগ্য ঘোষণার বিষয়ে সকল দল ঐক্যমত্য পোষণ কেরেছে। সেইসাথে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফ্যাসিবাদীর দোসরদেরকে অপসারণ করতে হবে। তিনি জুলাই বিপ্লব এবং ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে যেসব ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, আহত হয়েছেন, প্রিয়জন হারিয়েছেন তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা ও সহমর্মিতা জানান। জাতির এই গৌরবমণ্ডিত আন্দোলনে যারা যেভাবেই অংশ নিয়েছেন তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শোকাহত পরিবার পরিজনের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গত ৮ আগস্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব নোভেল জয়ী ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ধারাবাহিক ভূমিকা পালনকারী এবং ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের কল্যাণে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে আমরা অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যেতে চাই। সে ক্ষেত্রে অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে দেশের শান্তিকামী জনগণ এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, বিগত সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে। অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার এসব প্রতিষ্ঠানগুলো কতদিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে, তা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরণ ও প্রক্রিয়া কি হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতিদ্রুত প্রকাশ করবে এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
আজ সোমবার সকালে ঢাকাস্থ বিএমএ ভবনের শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন সভাকক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ‘ফ্যাসিস্ট, দুর্নীতিবাজ ও গণহত্যায় জড়িতদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত বক্তব্য রাখেন দলের আমীর পীর সাহেব চরমোনাই।
দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, অ্যাডভোকেট মো. জয়নাল আবেদীন, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানি, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসানাত আব্দুল কাইয়ূম, এবি পার্টির মহাসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনডিএম’র সভাপতি ববি হাজ্জাজ, মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, জাতীয় দলের সভাপতি সৈয়দ এহসানুল হুদা, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমম্বয়ক মুহাম্মদ সারজিস আলম,জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, ড. নাজমুল হায়দার কলিমুল্লাহ, প্রফেসর ড. আসিফ মিজান, সাবেক রাষ্ট্র দূত গোলাম মসিহ, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ফারুক হাসান, জাগপার সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ এনডিপির মহাসচিব ড. শাহাদাত হোসেন সেলিম, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম, ইসলামী ঐক্যজোটের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুফতী আব্দুল কাইয়ূম নেজামী, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব ড. মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল, লেবার পার্টিল সভাপতি ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামুল বশির, এছাড়াও ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ৩টি ভুয়া জাতীয় নির্বাচন করেছে। এসব একতরফা, ভুয়া, পাতানো ও ডামী নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করেছে। যারা তাদের এসব অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতা করে আওয়ামী লীগকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী। ৩টি অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনাকারী ৩টি নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা তাদের অবৈধ কাজের কুশিলব ছিল, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ অবৈধ নির্বাচনের সাহস না করে।
পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বর ও নৃশংস আওয়ামী দুঃশাসন উৎখাতের সংগ্রামের সূচনা করেছে আমাদের গর্ব শিক্ষার্থী সমাজ। তাদের অসীম সাহস, অকাতরে জীবনদান, সীমাহীন ত্যাগ ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব জাতিকে এক দানবীয় শক্তির কবল থেকে মুক্ত করেছে। আমাদের অকুতোভয় দামাল সন্তানেরা শুধু ক্ষমতার হাতবদলের জন্য এতো জীবন দেয়নি, এতো রক্ত ঝরায়নি। আমরা তাদের চোখের আকুতি, মুখের ভাষা এবং দেয়ালের গ্রাফিতি দেখে বুঝতে পারছি তারা আমাদের অতীত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়। তারা একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক শান্তির সমাজ এবং কল্যাণরাষ্ট্র চায়।
আমাদের সন্তানদের স্বপ্নের সেই সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানে আমরা সকল রাজনৈতিক শক্তি যদি আন্তরিক না হই তাহলে তারা আমাদের ক্ষমা করবে না। অতএব, আমাদের এখন মৌলিক কিছু বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে স্বপ্নের নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়োজনে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে এ মুহুর্তে মৌলিকভাবে দু’টি বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠতে পারে। ০১। পতিত ফ্যাসিস্ট, গণহত্যাকারী, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। ০২। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
এ ক্ষেত্রে ইসলমী আন্দোলন বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থার দাবী জানিয়ে আসছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও আমরা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তথা চজ পদ্ধতির নির্বাচন বিষয়ে জোড়ালো দাবী জানিয়ে ছিলাম। তখন যদি এ পদ্ধতি চালু করা হতো তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগের মতো একটি দল এভাবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী হওয়ার সুযোগ পেত না। আশার বিষয় হলো, এখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটির বেশির ভাগই সাংখ্যানুপাতিক তথা চজ পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানাচ্ছে।
আমরা যদি প্রত্যেকটি ভোটের যথাযথ মূল্যায়ণ করতে চাই, সম্মানিত প্রত্যেক ভোটারের প্রতিনিধি যদি আমরা জাতীয় সংসদে দেখতে চাই আর জাতীয় সংসদকে যদি আমরা সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর করতে চাই তাহলে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতিই আমাদের জন্য একটি উত্তম পদ্ধতি হতে পারে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বলেন, ইসলামী আন্দোলনের আমীর পীর সাহেব চরমোনাইকে আমি মনেপ্রাণে ভালবাসি। তিনি অত্যন্ত আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ মানুষ। উনাদের মাধ্যমে অর্থ্যাৎ পীর মাশায়েখগণের মাধ্যমে এদেশে ইসলাম এসেছে। কোটি কোটি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। কাজেই এই ধারাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এই উপমহাদেশ মুসলম শাসকগণ ৮০০ বছর শাসন করেছেন। তারা মনে করলে অন্য কোন ধর্মের লোক থাকতো না। কিন্তু মুসলিম শাসকগণ তা চাননি। বিগত ১৭ বছর ফ্যাসিবাদী শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ। আমার নামে দেড় শতাধিক মামলা ছিল। জেল ও কোর্টের বারান্দা ছিলো আমার ঠিকানা।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদের সময়ের তটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের কোন চক্রান্ত করলে ছাত্র-জনতা আবার মাঠে নামবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মতো মানুষ যদি বলেন শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের ডকুমেন্টস তিনি রাখেননি, তাহলে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা ছাত্রসমাজই নির্ধারণ করবে। ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের কোনো দালিলিক প্রমাণ নিজের কাছে নেই’ বলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের করা মন্তব্যের পর এ কথা বলেন সারজিস আলম।
জাতীয় পার্টি প্রসঙ্গে সারজিস বলেন, ‘জাতীয় পার্টি হলো একটি বিবেকহীন দল। যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিয়েছে। তাদের নিয়ে রাজনৈতিক টেবিলে আলোচনা করার যুক্তি নেই।’ সারজিস আলম আরও বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সিস্টেম এখনো সরেনি। বিভিন্ন এজেন্সি ও কুচক্রী মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিহত করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা আবার রাজপথে নামবো।’